বিয়ের আগে মৌলিনাথের একজন কল্পনার নারী ছিল। সেই নারীটি অবসর সময়ে ওর কাছে মাঝে মাঝে আসতো। সারাদিন কাজের মধ্যে তাঁকে দেখা যেত না। রাতে ঘুমোতে যাবার সময় জানালা দিয়ে খোলা মাঠের দিকে তাকালে, দেখা যেত, সেই স্বপনচারিনী সাদা শাড়ি পরে খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসতো।
তখন আকাশ থেকে জোসনা বৃষ্টি হচ্ছে।
বৃক্ষ শাখায় পাখিদের কিচিরমিচির। আকাশে মিটিমিটি তারা। দূর আকাশে একলা চাঁদ জেগে আছে। জেগে থেকে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখছে।
মৌলিনাথ সেই মেয়েটির নাম দিয়েছিল, নন্দিনী।
তেমন জোসনা ধোয়া মুখ আজ অব্দি ওর চোখে পড়েনি।
নন্দিনী এসে বলত, এই যে আমি এসেছি, আমি এসেছি, আমি এসেছি।
ক্লান্ত দিনের শেষে এই যে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা বড্ড জরুরি ছিল আমার।
মনে মনে তুমি তো আমাকে ডাকছিলে, তাইতো এলাম।
কোথায় তোমার বাড়ি?
বহুদূর, দূর মধুপুর।
সেখানে পাহাড় আছে?
আছে।
সেখানে ঝর্ণার জলে মেয়েরা স্নান করতে যায়?
যায় তো।
ওখানে শাল গাছে জোসনা রাতে সাদা ময়ূর দেখা যায়?
হ্যাঁ তো।
ওখানে আমাকে নিয়ে যাবে নন্দিনী?
কেন?
আমার খুব ইচ্ছে করে, তোমার কাছে ছুটে যাই।
তাই বুঝি! এক্কেবারে পাগল।
ঠিক বলেছো। তোমার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গেছি।
তোমার কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না এতদিন?
ছিল ছিল। সুতপা, শর্মিষ্ঠা, অনন্যা, উপালী, এরা সবাই আমার বন্ধু।
তাহলে?
কিন্তু প্রেমিকা নয়।
কে তোমার প্রেমিকা?
আমার ঘরে আসবে?
কেন?
আমি যাকে ভালোবাসি, তাঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।
মৌলিনাথ ঘরের মধ্যে বেলজিয়াম কাঁচের আয়না দেখালো।
কোথায় তোমার প্রেমিকা?
আয়নার দিকে চেয়ে দ্যাখো।
আয়নায় আমি ছাড়া কেউ নেই।
এখনো বুঝতে পারো নি?
বুঝলাম।
কিন্তু আমাকে তুমি কেমন করে পাবে?
কেন?
আমি তো তোমার কল্পনা। আমার তো কোন শরীর নেই।
শরীর সর্বস্ব ভালবাসায় আমার বিশ্বাস নেই।
ভালোবাসার মানুষের কাছে তুমি কি চাও?
শ্রদ্ধা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা আর বড় মন।
এতসব এখানে পাওয়া যায় নাকি?
পাওয়া যায় না বলেই তো, আমি ছুটে ছুটে তোমার কাছে আসি, তোমার সঙ্গে একটু কথা বললে, আমার দিনরাত পাল্টে যায়।
কিন্তু আমার সময় কম। কেন যখন তখন আমাকে কাছে ডাকো!
তুমি বিরক্ত হও। সেটা জানি। কিন্তু কি করবো, আমার মন আমার বশে নেই।
মানে?
আমি তোমায় ভুলে থাকতে পারিনা।
কেন এমন হয়?
সত্যিকার ভালবাসলে।
কি করে বুঝবো, তুমি আমায় ভালোবাসো?
আমি যখন যেখানে গিয়েছি, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, সেখানে গাছের কান্ডে, কিংবা পাহাড়ের গায়ে, অথবা, সমুদ্রের বালুকাবেলায় তোমার নাম লিখে এসেছি।
লিখেছি, নন্দিনী, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে ভালবাসি।
সুখের দিনে অনেকে ভালোবাসে। তুমি কি আমার দুঃখের দিনেও আমার পাশে থাকবে?
আমি যেখানে থাকি, সেখানে আকাশ গাঢ় নীল,
পথের পাশে রুপোর গাছ। গাছে গাছে কত রকম ফুল, কত রকম ফল, কত রকম পাখির ডাক।
ওখানে কোনো কলকারখানা নেই? লেবার ট্রাবেল নেই? কারখানায় ধর্মঘট হয় না?
কখনো না।
কেন?
ওখানে যারা কাজ করেন, তাঁরাই কারখানার মালিক।
নন্দিনী, আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে?
তার আগে এখানকার মায়া কাটাতে হবে।
তা যা বলেছো। আচ্ছা, ওই দেশটা কেমন?
সেটা স্বপ্নের দেশ। ঢেউ খেলানো নদী, বিশাল সমুদ্র,
পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা নির্জন দ্বীপ।
আমি ওখানে গিয়ে থাকতে পারবো?
কেন নয়। আমি তো তোমার সঙ্গে আছি।
তুমি আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে না তো?
এ কথা কেন বলছো?
পাঁচ বছর আগে অরুন্ধতী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
সবাই অরুন্ধতী নয়।
সত্যি বলছো?
হ্যাঁ। সবাই ভালোবাসা দিতে জানে না, ভালোবাসা পেতে জানে না। এদের জন্য কষ্ট হয়।
নন্দিনী, তুমি আমার কাছে আবার কবে আসবে?
যেদিন তুমি ডাকবে।
আমি চাই, প্রতিদিন রাতে তুমি আমার জানালায় একবার দেখা দিয়ে যেও।
তাহলে কি বলবে আমায়?
কিছু না। আমি শুধু তোমার মুখের দিকে একভাবে চেয়ে থাকবো।
কেন?
তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর আমি আর অন্যায় করতে পারি না। তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর আমি অনায়াসে অন্যকে ক্ষমা করে দিতে পারি। তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর আমার বুকের মধ্যে বহুদিনের অসুখগুলো সব সেরে গিয়েছে।
ভ্যাট, তাই কখনো হয় নাকি?
তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
জানি। সবাই এই কথা বলে।
মানে?
আমার মাও বলতেন।
আবার এসো। তুমি এলে নন্দিনী, আমি আলো পাই।
আমার কাছ থেকে এই আলোটুকু কেড়ে নিও না।
আর যদি আমি কখনো তোমার কাছে আর না আসি?
খুব কষ্ট হবে আমার। তবু তোমার কাছ থেকে যে আলো পেয়েছি, সেটা আমার সারা জীবনের স্বর্ণ কমল সঞ্চয়।
এবার আমি চলে যাবো। আমাকে পাহাড় নদী সমুদ্র গাছপালা পেরিয়ে বরফের দেশ ছাড়িয়ে কুয়াশার আস্তরণের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।
নন্দিনী, আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না। আমার বুকের মধ্যে পরম মমতায় গভীর যত্নে তোমার জন্য একটা রাজ সিংহাসন পেতে রেখেছি। আমার মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে তুমি থেকে যাবে।
বাইরে ভোর হয়ে এসেছিল। ভোরের পাখি ডাকছিল। ধানক্ষেত পেরিয়ে আলপথের উপর ভাসতে ভাসতে আমার নন্দিনী, আমার কল্পনার নন্দিনী তখন ভেসে যাচ্ছে।
মৌলিনাথ মনে মনে বলল, নন্দিনী, তুমি আমার মনের গভীরে আছো। যখন চাই, তোমাকে দেখতে পারি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তুমি কি জানো,
প্রতিদিন তোমার সঙ্গে আমার কত কথা হয়।
জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরাজিত মানুষ আমি, নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে মৌলিনাথ মনে মনে বলল, আমার একজন নন্দিনী ছিল, আমার একজন নন্দিনী আছে, আমার একজন নন্দিনী থাকবে।