এই নিয়ে পরপর তিনদিন একই ঘটনা ঘটলো। সকাল দশটা নাগাদ সৌভিক অফিস যাবার জন্য বাস ধরতে বের হয়, তখন পরপর তিনদিন মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়।
আজ সকালে টালিগঞ্জের দিক থেকে বাসটা আসতে দেরি হয়েছিল, তখন মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়। সোজাসুজি সৌভিককে প্রশ্ন করে, আপনি মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি, আমি দেবপ্রিয়া।
শ্যামবাজারের বিয়ে বাড়িতে দেখা হয়েছিল।
সৌভিকের মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ, তাইতো!
ও প্রশ্ন করে, এখন কোথায় চলেছেন?
মেয়েটি বলে, অফিসে, ডালহৌসিতে অফিস।
বাস এসে পড়ে। সৌভিক বাসে ওঠে। যাবার আগে বলে, আবার দেখা হবে। ভালো থাকবেন।
বাসে উঠে ও জানালার কাছে সিট পেয়ে যায়।
দেবপ্রিয়ার কথা ভাবতে থাকে। ওর বন্ধু সৌজন্য মুখার্জির বিয়েতে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মেয়েটার কথার মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের স্নিগ্ধতা আছে। এই ভাবনাটা সৌভিকের ভালো লাগে।
পরদিন গড়িয়াহাট মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়াতে গিয়ে পর পর দুটো বাস সৌভিক ছেড়ে দিল। কারণ, তখনো দেবপ্রিয়া এসে পৌঁছয় নি।
সৌভিক সিগারেট টানছিল। খানিক বাদেই দেবপ্রিয়া এসে বলল, আপনার বাস আসেনি বুঝি?
হ্যাঁ এসেছিল। আমি উঠিনি। যেতে দিলাম।
কেন?
আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম।
বাবা, আমার কি সৌভাগ্য!
কেন?
আমি ভাবতেই পারি না, আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করতে পারে!
দেখতেই তো পারছেন, এই অধম আপনার জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। পরপর তিনটে সিগারেট শেষ।
একটা কথা বলবো?
বলুন!
রোজই তো অফিস যাই, আজকে অফিস না গিয়ে
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে একবার আড্ডা মেরে এলে হয় না?
তাহলে অফিস যাব না?
রোজ রোজ অফিস আমার একদম ভালো লাগে না।
বাদ দিন তাহলে।
একটা ট্যাক্সি ডাকি।
ডাকুন।
ওরা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে পড়ে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকে।
দেখলেন, আপনাকে কেমন অফিস কামাই করিয়ে দিলাম।
দেবপ্রিয়া হাসলো। বলল, আপনি মনে হয় আমাকে কিছু বলতে চাইছেন?
হ্যাঁ, সেটা ঠিক। কিন্তু কি করে সেই কথাটা বলব, ভাষা আসছে না।
বলুন না, কোন প্রবলেম নেই।
ভালো লাগে আপনাকে। ভালোবাসি তো! এই কথাটা সাহস করে বলতে পারছি না।
কী ভীতু মানুষ রে বাবা!
সত্যি, তা যা বলেছেন। সেরেফ ভীতু বলে জীবনে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারিনি।
তাই নাকি?
এখন জানতে চাই, আপনার মতামত কি?
একটু সময় চাইছি। ভাবতে হবে তো! একটা আস্ত জীবনের ব্যাপার।
ঠিক আছে। আপনি ভেবে উত্তর দেবেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।
ভিক্টোরিয়ার মাঠে খানিকটা ঘোরাঘুরির পর ওরা বাইরে বেরিয়ে আসে। সৌভিক বলে, চলুন, একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি। একটু কফি খাওয়া দরকার।
হ্যাঁ চলুন।
দিন তিনেক বাদে রাতের দিকে দেবপ্রিয়ার ফোন এলো।
এই প্রান্তে সৌভিক বলল, কি ব্যাপার? পরপর দুদিন গড়িয়াহাট মোড়ে অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে অফিস গেলাম। আপনার দেখা নেই।
আসলে, মায়ের সঙ্গে পুজোর কেনাকাটায় বেরিয়েছিলাম। দুদিন অফিস যাইনি।
ও, আমি ভাবলাম, আপনি আমার উপর খুব রেগে গেছেন।
না না, তা কেন?
আগামীকাল আসছেন?
আসবো।
আমি অপেক্ষা করবো।
পরদিন সৌভিক গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। একটু বাদেই দেবপ্রিয়া এলো। বলল, এই যে মশাই,
আমি এসে গেছি।
সৌভিক ওর দিকে তাকিয়ে গভীর মুগ্ধতায় ডুবে গেল। চোখে কালো চশমা। পরনে মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ। আজকে ওকে একেবারে অন্যরকম ভালো দেখাচ্ছে।
সৌভিক বলল, বিকেলে ছুটির পর, আজ একটু দেখা করা যাবে কি?
কিভাবে?
অফিস ছুটির পর আমি আপনার অফিসের সামনে দাঁড়াবো।
আসুন।
তখন বিকেল শেষ হয়ে আসছে। সৌভিক অফিসের সামনে একটা টি স্টলের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
দেবপ্রিয়া বেরিয়ে এলো। বলল, সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। হাতে পেন্ডিং কাজগুলো শেষ করতে করতে সামান্য লেট।
সৌভিক বলল, নো প্রবলেম। চলুন, বড্ড খিদে পেয়েছে। আর্সেনালে বিরিয়ানি খেতে যাই।
আপনি বিরিয়ানি খুব ভালো খান বুঝি!
হ্যাঁ। তবে মোগলাইয়ের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা।
তাহলে মোগলাই নয় কেন?
এখানে তেমন দোকান নেই।
চলুন।
দু প্লেট বিরিয়ানি অর্ডার করে ওরা মৃদুস্বরে কথা বলছিল।
সৌভিক বলল, আমার কথাটা ভেবে দেখেছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু আমারও আপনাকে অনেক কথা বলবার আছে। সেসব জানবার পর যদি আপনি এগোতে চান, আমাকে বলবেন।
কি? কি এমন কথা।
অঞ্জন সেনগুপ্ত বলে একজন আমাকে ভালবাসতেন। বছরখানেকের প্রেম। তারপর অফিসে কাজের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে ইউ কে তে চলে যেতে হয়। সেখানেই সে বিয়ে করে সেটেল করেছে।
সেই থেকে আমার ভালোবাসা শব্দটার উপর বিশ্বাস হারিয়ে গেছে।
বেয়ারা ওদের সামনে দু প্লেট বিরিয়ানি রাখে।
সৌভিক বলে, আপনি বুদ্ধদেব গুহর লেখা পড়েন?
হ্যাঁ, একটু উষ্ণতার জন্য পড়ে একেবারে বুঁদ হয়ে গেছিলাম।
ভালোবাসার অর্থটা অনেকে বোঝেনা। আমি আপনাকে আপনার দোষ গুন সব সুদ্ধ ভালোবাসতে চাই। আমি আপনার অতীত সম্পর্কে আগ্রহী নই। আপনার বর্তমানটাকে আমি ভালোবাসি।
দেবপ্রিয়া গভীর আবেগে সৌভিকের কাঁধে হাত রাখলো।
বলল, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?
সৌভিক বলল, আমার সঙ্গে কিছুদিন মিশুন। তাহলেই আমাকে বুঝতে পারবেন।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ওরা পথে নেমে এলো।
পরদিন অফিস ছুটির পর ওরা আউটারাম ঘাটে এলো। তখন বিকেলের সূর্যটা লাল আকাশে আলো ছড়িয়ে ডুবে যেতে বসেছিল।
দেবপ্রিয়া বললো, এবার থেকে আর আপনি নয়। তুমি বলতে হবে তো!
সৌভিক বলল, আমিও সেটা ভাবছিলাম। বলতে পারিনি।
বলতে হবে তো! মনের কথাগুলো চিৎকার করে বলা দরকার।
সৌভিক কেমন আবেগে ডুবে গিয়েছিল। ধার কাছে কোন মানুষজন ছিল না।
সৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
কথাগুলো বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেসে গেল।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে সদর রাস্তায় উঠে এলো।
তখন মাটিতে অন্ধকার নেমেছে। কলকাতা শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।
সৌভিক বলল, জানো, সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার লাইন আমার খুব প্রিয়।
কোন্ কবিতাটা?
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
যেন মায়াপাশ।
দারুন দারুন। তুমি তো কবিতা লিখতে পারো।
লিখি তো।
ছাপাও না?
আমার লেখা কে পড়বে?
আমি পড়বো। আমার জন্য লেখো।
এমন ভাবে কেউ কখনো আমাকে বলেনি।
আমি বললাম তো!
ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য কবিতা লিখবো।
যখন ভালো কবিতা লিখবে, তখন দেখবে, এই কবিতা শুধু আমার নয়, সকলের মনের কথা হয়ে গেছে।
এভাবে কখনো ভাবি নি, প্রিয়া!
আমাকে এই নামেই ডেকো।
আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে।
পারবো পারবো।
চলো। তোমায় বাসে তুলে দিই। কাল অফিস ছুটির পর আবার দেখা হবে।
ঠিক আছে।
সৌভিক দেবপ্রিয়ার হাতটা ধরল। বলল, জীবনে যেমন অবস্থায় আসুক, এই হাত আমি কোনদিন ছাড়বো না।
দেবপ্রিয়ার চোখে জল এসে গিয়েছিল। বলল, আমার মরুভূমির মতো জীবনে এমন ঝমঝম করে বৃষ্টি আসবে কোনদিন, স্বপ্নেও ভাবিনি।
সৌভিক বলল, তোমার দুঃখ টুকু আমাকে দেবে, আমার সুখটুকু সব সময় তোমার জন্য থাকবে।
দেবপ্রিয়া বাসে উঠে পড়ল। বলল, সাবধানে বাড়ি যেও। কাল দেখা হবে। টা টা।
বাসটা দূরে মিলিয়ে যেতে, সৌভিক একটা সিগারেট ধরালো। দূরে লাউড স্পিকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে উঠছিল,
একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি
তাই নিয়ে মনে মনে
রচি মম ফাল্গুনী,
কিছু পলাশের নেশা কিছু বা পাতায় মেশা।
অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে গানের সুরটা মিলিয়ে যায়। সৌভিক আফসোস করে না।
ও অনুভব করতে পারে, প্রাণের মধ্যে যে গানের সুর বসে গেছে, বাইরের আওয়াজ সেই গানের সুরকে প্রাণের ভিতর থেকে সরিয়ে দিতে পারে না।
ও দ্রুত ভিড়ের মধ্যে হলিউড নায়ক গ্রেগরি পেকের
স্টাইলে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়।