সত্তরের দশকের শেষের দিকে ও আশির দশকের প্রথম দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খাল খনন কর্মসূচি ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারগুলো রাজনৈতিক ইগো’র কারণে এই কর্মসূচিকে উপেক্ষা করেছেন। যার ফলে সারা দেশের খালগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। দেশের জলাধার কমে যাওয়া, উষ্ণ আবহাওয়া বিদ্যমান ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়। আবহওয়ার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ সেটা আর এখন বুঝা যাচ্ছে না। চারটি ঋতুর বেশি অনুভব হয় না। খালে পানি না থাকা ও ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতার কারণে দিনদিন নিচে নেমে যাচ্চে ভূর্গভস্থ পানির লেয়ার। এ কারণে সেচ সুবিধাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভবনা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খালগুলোর মাধ্যমে বর্ষাকালে পানি ধারণ ও কৃষি কাজের জন্য পরবর্তীতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ এখন চরম ভারসাম্যহীন। গ্রীষ্মকালে খরা ও বর্ষাকালে বন্যা এখন আমাদের জনজীবনে অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখন পুকুর, খাল ও নদী গুলোর দিকে নজর দেওয়াটা সময়ের দাবি। ইতিমধ্যে নদী, খাল,পুকুর সহ জলাধার ভরাটের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। সেই সাথে পানি উন্নযয়ন বোর্ড, বিএডিসি, জন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সঠিক তদরকি ও সরকারের অধিকতর ব্যয় বরাদ্দের মাধ্যমে খালকাটা কর্মসূচিকে এগিয়ে নেয়া দরকার।
উল্লেখ্য, দশ বছর আগে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় মোট ৭,৫৩,২৩২টি পুকুর ও দিঘী ছিল। জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ২২,০০০ কিঃমিঃ খাল। সময়ের প্রয়োজনে ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের আওতায় এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এলজিইডি’র দেশব্যাপী “নির্বাচিত খাল ও পুকুর পুনঃখনন প্রকল্প”টি অন্যতম দৃষ্টান্ত।
গত ২৩ জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার খাল এই প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথম অবস্থায় প্রকল্প প্রনয়ন করা হয়। এই প্রকল্পটির ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। প্রায় ২০০০কিঃমিঃ খাল ও ২১০০ একর পুকুর খননের জন্য এই প্রকল্পে প্রথম সংশোধনীতে বরাদ্দ ছিল ১৭৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাল ও পুকুর পাড় সংরক্ষণের পর গাছ লাগানোর কর্মকান্ডে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এলজিইডি কর্মকর্তারা। সাধারণত নিচু এলাকায় এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমা থাকে। রোপনকৃত গাছগুলো একারনে বাঁচে না। আবার কিছু জায়গায় পূর্বের বৃক্ষরোপন থাকায় নতুন গাছ লাগানো যায়না। কোথাও কোথাও খালপাড়ে সরকারি জায়গা না থাকায় গাছ লাগানোটা ছিলো অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। আবার খালপাড়ে গাছ লাগানো হলে জমিতে ছায়া হয়, এজন্য খালের আশেপাশে লোকজন গাছ লাগাতে বাধা দেয়। এসব কারণে প্রকল্পে গাছের জন্য বরাদ্দকৃত কমপোন্টের টাকা সম্পূর্নরুপে কর্তন করে, প্রথম সংশোধনী ২০২০ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম সংশোধনীতে গাছের জন্য আলাদা বরাদ্ধ রাখা হয়নি। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী খাল পাড়ে গাছ লাগানো যাবে। এখানে আরোও উল্লেখ্য যে, বর্তমান অবস্থার প্রয়োজন অনুযায়ী কোথায় গাছ লাগানো হলে, খালের বরাদ্দের মোট বরাদ্দের ১% বেশি যায় না। এরপরে ২০২৪ সালে প্রথম দিকে কিছু কিছু জায়গায় কর্তন করে ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ একনেকের সভায় অনুমোদিত ১৭৫৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির ১৬২ কোটি টাকা কর্তন করে ১৫৯৪ কোটি টাকার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
ইতিপূর্বে ‘আইএমইডি’ প্রকাশিত রিপোর্টটিতে বিভ্রান্তি থাকলে গত সপ্তাহে (১৭-০৯-২০২৪ইং) সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটে। যার সত্যতা স্বীকার করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এ সংস্থাটি।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী জনাব মোঃ আলি আক্তার হোসেন এ সম্পর্কে আলাপকালে বলেন, আমরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল মেশিন আরটিকে ও টোটাল স্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে খাল গুলো সার্ভে ও মাটির ভলিয়াম নির্ণয় করতেছি। কারণ মাটির কাজে মানুষের নেতবিাচক মনোভাব থাকে। ফলে ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের আওতায় মাটি ম্যানেজমেন্ট আধুনিক ডিজিটাল মেশিন দ্বারা হচ্ছে। গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এল্যাইমেন্টের শুদ্ধতাসহ এসব টপোগ্রাফিক সার্ভে, ডিজিটাল ডাটা, ফটোগ্রাফ, ভিডিও গ্রাফিসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ, খনন কাজ এলজিইডি করতেছে। যা ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশ, কৃষি ও জলবায়ুর উন্নয়নে অর্থাৎ ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জনাব মোঃ ফজলে হাবিব বলেন, চলমান বন্যায় নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার সহ দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের যেসব স্থানে এলজিইডি খাল খনন করিয়াছে, পুনঃখনন কৃত খালগুলো পানি নিষ্কাশনের ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। লক্ষীপুর জেলা এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী একরামুল হক ও রামগতি উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার চররুমিজ ইউনিয়নের গোফটার খাল এ ব্যাপারে বন্যায় অনন্যা মডেল। এখানে আশেপাশে গ্রামগুলো থেকে দ্রুত পানি সরে গেছে। বন্যায় তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
নোয়াখালী এলজিইডির প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা পাইলট প্রকল্প হিসেবে ২.৭৪ কিলোমিটার খাল খানন করেছি। অধিকাংশ খাল গুলো এখন অবৈধ দখলদারের কবলে চলে গেছে। তা উদ্ধার ও সংরক্ষণ জরুরী। অন্যথ্যায় জায়গায় জায়গায় পানি নামায় প্রতিবদ্ধতায় থাকবে।
ফেনী এলজিইডির প্রকৌশলী গোলাম ফারুক বলেন, সোনাগাজী ও দাগলভূঞায় আমরা প্রকল্পধীন খালগুলো পুনঃখনন করাতে এবারের ভয়াবহ বন্যায় মানুষের সুফল এ দারুন খুশি। তাই এলাকাবাসী অবশিষ্ট খাল গুলো পুনঃখননের প্রত্যাশা করেন।
কুমিল্লা এলজিইডি’র কনসালন্টে প্রকৌশলী বাচ্চু খান বলেন, লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, দাউদকান্দি, হোমনা, বুড়িচং ও মনোহরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় আমরা খাল খনন করেছি। অবশিষ্ট খালগুলো পুনঃখনন জরুরি।
ঢাকায় নবাবগঞ্জ উপজেলা উপজেলা প্রকৌশলী জুলফিকার আলী বলেন, আমরা ১০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করেছি। এর মধ্যে ইছামতি খাল হতে বেনুখালি খালটি এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই খালপাড়ে আসে সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবগুলো খাল বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা এবারের বন্যায় দক্ষিণ পুর্ব অন্চলের ১১টি জেলার মানুষ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। যা পরিবেশ সংরক্ষণ, সেচ, মৎস্য চাষাবাদসহ খাল ও নদীপথে কম খরচে যাতায়ত এবং মালামাল পরিবহণে অপরিহার্য । এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। এর সাথে সম্পৃক্ত করা দরকার স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী ও যুব সম্প্রদায়কে। উপজেলা ভূমি অফিসকে এই খালগুলোর অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে।
|