প্রিন্ট এর তারিখঃ মে ২, ২০২৫, ৬:৫১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ১০, ২০২৪, ৩:১৪ এ.এম
তেমন মৃদুমন্দ বাতাস এখন জীবনে আর বয়ে যায় না, মাটির ঘরে স্বর্গ সুখের ছোঁয়া জীবন থেকে কতদিন আগে হারিয়ে গিয়েছে, মাটির উঠোনে বসে ঠাকুমার কাছে গল্প শোনার দিন কবে যে কোথায় পথ হারালো, আকাশ জুড়ে জ্যোৎস্নার শীতল আলো মনের আকাশ জুড়ে কল্পনার আলপনা এঁকে দিত, সেই সব দিন গুলোকে আজকাল খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
সকালে দুধ দিতে আসতেন মালুম কাকু।ওর আসল নাম পুনি দেও। মাঝে মাঝে মা-বাবার সঙ্গে কথাবার্তার সময় উনি বলতেন, মালুম হুয়া। সেই থেকে আমি তাঁকে মালুম কাকু বলে ডাকতাম।
পৃথিবীটা তখন অনেক সবুজ ছিল। তখন সংসারে ভালো মানুষের অভাব ছিল না। বড়রা কত যে ভালোবাসা দিতেন! পাশের বাড়ির খ্রিস্টান পরিবারের সবাই কী ভালো যে বাসতেন! ক্ষিতীশ
আঙ্কেল শান্ত স্বরে আমার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করতেন, পড়াশুনো ভালো করে করছো তো, বাবলু?
বড়দিনে কত রকম দামী দামী কেক পেস্ট্রি পাঠাতেন। আঙ্কেলকে দেখলে মন ভালো হয়ে যেত।
সংসারে এত মানুষ আজকাল দেখি, তেমন মানুষ গুলোর জন্য আজকাল ভারী কষ্ট হয়।
মাঝে মাঝে ভাবি, সংসারে আজকাল মানুষের এত আকাল কেন? ওই লোকগুলো কেউ ধনী ছিলেন না। সীমিত সামর্থ্য ছিল, বুক ভরা ভালোবাসা ছিল।
তাই ওই বয়সে আপন পর বোঝবার সুযোগ পাই নি।
মানিক মোল্লার মাটির বাড়িতে আট টাকা ভাড়ায় আমরা থাকতাম। বর্ষাকালে পাশের ফাঁকা মাঠে ব্যাঙ ডাকতো। মাঠের কিনারায় গাব গাছের পাশে একটা ডোবা ছিল। সেখানে সোনা ব্যাঙের গ্যাগোর গ্যাং কনসার্ট বাজতো। ভিজে সবুজ মাঠ থেকে
কাকু ভেজা শালিক তুলে আনতো। আমাকে বলতো, বাবু! দ্যাখ্ ওর খুব কষ্ট। শীতে কাঁপছে। ওকে বাঁচাতে হবে।
বাড়িতে পুজো করতে আসতেন, ঠাকুর দাদু।
ঘাড় অব্দি সাদা পাকা চুল। আমাকে বলতেন, আমাকে জল দাও। পা ধুই।
কী স্নেহ পূর্ণ ছিল সেই ডাক। কত মায়া ছিল, সেই কথাগুলোর মধ্যে। কবে যে সেই ভালোবাসার পৃথিবীটা চোখের সামনে থেকে সরে গেল।
মুখোশ আঁটা ভদ্র মানুষদের মেকি ব্যবহার দেখে দেখে আজ ক্লান্ত। পৃথিবীটাকে বেমিশাল স্বার্থপরতার জঞ্জাল বানিয়ে এরা ছাড়লো।
আজকের স্বার্থপর পৃথিবীর কথা নয়। সেদিনের সরল পৃথিবীর একজন মানুষের কথা আজ শোনাবো।
পুরো নাম, বাবু অনিল কুমার মন্ডল।
গায়ে ফুলহাতা গেঞ্জি। হাঁটুর উপরে ধুতি। মাথায় সাদা হয়ে যাওয়া কাঁচা পাকা চুল। এখনো মনে হয় দেখতে পাচ্ছি, মাঠের ভেতর সরু রাস্তা পেরিয়ে ঝুঁকে হাঁটছেন মোড়ল কাকু। হাতে একটা বিরাট সাইজের লম্বা মান কচু। উঠোনে এসে হাঁক পাড়ছেন, বৌমা, মান কচু এনেছি।খেয়ে দেখে জানিও। মা মাটির বারান্দায় ওনাকে আসন পেতে দিতেন। ওখানে বসে মোড়ল কাকু চা খেতেন। সংসারের গল্প করতেন। তারপর মাঠ পেরিয়ে বাড়ি চলে যেতেন।
আমাকে বলতেন, বাবা, আমি মুখ্যু মানুষ। পড়াশোনা করতে পারিনি। পড়াশুনো করতে না পারলে, আমাদের আর দাঁড়াবার জায়গা নেই।
দুর্গা পুজোর পর ওনার বাড়িতে বিজয়া করতে গেলে, থালায় করে ওনার বউ, আমাদের কাকিমা বোদে জিলিপি সাজিয়ে দিতেন। কত গরীব মানুষ। অথচ, বুকের ভেতরে একটা কত বড় মন পুষে রেখেছিলেন এনারা।
মোড়ল কাকুর মধ্যে কখনো কোনো দেখানেপনা কোনদিন লক্ষ্য করিনি।
আমাকে বলতেন, বাবা, সংসার বড় কঠিন জায়গা। এখানে চলবে, বড় সাবধানে। দেখে শুনে পথ চলবে।
পড়ে যাবে, পায়ে রক্ত ঝরবে, আবার উঠে দাঁড়াবে, আবার হাঁটবে, হেরে ফিরে আসবে না।
সামনে বাঁশ বন। ডান দিকে সরু খাল। বাঁদিকে বড় পুকুর। পাড়ে কাঠবাদাম গাছ। জামরুল গাছ। দুপারে শান বাঁধানো ঘাট।
মোড়ল কাকু একদিন আমাকে ডেকে বললেন, পারলে মানুষের উপকার করবে, কারো ক্ষতির চিন্তা করবে না, অন্যের ক্ষতি করতে গেলে, জানবে, নিজের ক্ষতি হবে।
তখন অল্প বয়েস। এসব ভারী ভারী কথা ভালো করে বুঝতাম না। অথচ, কী আশ্চর্য! কথাগুলোর মানে সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি। আজও ওই কথাগুলো মধ্যরাতে কানে বাজে।
মোড়ল কাকুর কোন সন্তান ছিল না। পাড়ার সব বাচ্চারা তাঁর কাছে খুব প্রিয় ছিল। সরস্বতী পূজার সময় এসে বলতেন, তোরা পুজো কর। আমি তোদের ঠাকুর কিনে দেবো। বলতেন, শুধু পুজো করলে হবে না, পড়াশোনা করতে হবে, নইলে সরস্বতী ঠাকুর পাপ দেবে।
তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। বাবা কসিম উদ্দিনের কাছ থেকে পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করলেন।
আমরা নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম। এখানে নতুন বন্ধু পেলাম। কিন্তু পুরনো বাড়ির স্মৃতি মন থেকে কিছুতেই গেল না।
তখন কলেজে পড়ি। বাজারে নিবেদনী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে মোড়ল কাকুর সঙ্গে দেখা। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই, মাথায় হাত রেখে বললেন, মানুষ হ বাবা। বাবা মায়ের পাশে দাঁড়া।
বিএ পাস করে স্কুলে চাকরি পেলাম। একদিন রোববার সকালে মিষ্টি নিয়ে মোড়ল কাকুর বাড়ি গেলাম। কাকিমার হাতে মিষ্টি তুলে দিয়ে প্রণাম করলাম।
মোড়ল কাকু বললেন, দ্যাখ্ দিকি, তোকে দেখে কি ভালো লাগছে!
মাস ছয়েক বাদে পূজো এসে গেল। আমি কাকীমার জন্য লাল পাড় শাড়ী আর মোড়ল কাকুর জন্য ধুতি পাঞ্জাবি নিয়ে গেলাম।
হাতে তুলে দিতেই, মোড়ল কাকু কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার তো নিজের ছেলে নেই। আমাকে কেউ কখনো কিছু দেয়নি। এ আমার বড় পাওয়া, রে বাবা!
আমি ভাবছিলাম, কত অল্পে খুশি ছিলেন আগেকার মানুষেরা। এই মানুষগুলো আমাকে জীবন ভাবনা শিখিয়েছিলেন। কত যে কৃতজ্ঞতা এমন মানুষের কাছে। মুখ ফুটে কোনদিন বলতে পারিনি। আমার সঙ্গে মোড়ল কাকুর কোন রক্তের সম্পর্ক ছিল না।
অথচ, নির্বিবাদে ভালোবেসে গিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহের একটা সময়ে বাড়িতে মান কচু দিতে আসতেন। এর বেশি কিছু না। কিন্তু বুকের মধ্যে গভীর ভালোবাসা থাকলে, তা কোনো না কোনভাবে
জীবন আচরণে প্রতিফলিত হবেই।
একদিন মোড়ল কাকুর মৃত্যু সংবাদ পেলাম।
প্রতিদিনের মতো খেয়ে দেয়ে শুতে গিয়েছিলেন। বুকে ব্যথা। ডাক্তার ডাকার আগে, সব শেষ।
পরদিন সকালে ওনার বাড়িতে গেলাম। উঠোনে মৃতদেহ। শ্মশানে যখন ওনাকে চিতায় তোলা হলো,
আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললাম। বুকের মধ্যে কি যে এক ধরনের কষ্ট, কোন ভাষাতে বোঝাবার সামর্থ্য আমার নেই। চিতার আগুন দাউ দাউ জ্বলে উঠলো। আমি দেখলাম, চোখের সামনে শৈশবের ভালোবাসার মানুষটা পুড়ে যাচ্ছেন।
মনের চোখ দিয়ে আমি দেখছিলাম, সবুজ মাঠ পেরিয়ে মান কচু হাতে মোড়ল কাকু আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন।
তাঁর কণ্ঠস্বর কানে বেজে উঠছিল, আমরা গরীব। কেউ জায়গা করে দেবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে বাবা!
সংসারে আজকাল কত মানুষ দেখি, আগের মতো
সেইসব চওড়া বুকওয়ালা মানুষগুলো আর দেখি না।
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে তাই দিনে দিনে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা প্রতিদিন মরে যাচ্ছে।